স্মৃতির মণিকোঠায় দীননাথ স্মৃতি পাঠাগার
রেশমিন খাতুন
আজ আমাদের লাইব্রেরী দীননাথ স্মৃতি পাঠাগার নিয়ে কিছু লিখতে ভীষন ইচ্ছে করছে। এই লাইব্রেরীর সাথে আমার ছোটবেলার বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে। যখন ক্লাস পঞ্চম শ্রেণীতে পড়তাম, তখন থেকেই এখানে আসা যাওয়া শুরু করেছি। প্রথম যখন লাইব্রেরীর সদস্য হই, তখন কার্ড বানিয়ে দিয়েছিলেন এক দিদি। ভীষন ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এখন তার নামটা কিছুতেই মনে করতে পারি না। মনে আছে তিনি আমায় খুবই ভালোবাসতেন। আমার মাত্র একটা সদস্য কার্ড হলেও, আমি চাইলেই তিনি আমাকে দুটো বই বেশী দিতে দ্বিধাবোধ করতেন না।
সেই তখন থেকেই ওই লাইব্রেরীর কাঁচের আলমারির রঙিন বই গুলো দেখে ভীষন ভীষন লোভ লাগত। কিন্তু সেই দিদি বলতেন ওগুলো বড়দের জন্য। বলতেন 'মাধ্যমিক দাও, তার পরে নিও। ততদিনে ওগুলো পড়ে বোঝার মত মানসিকতা তৈরী হবে তোমার"। আমার বড়দির সিনিয়র কার্ড ছিল, তাই বড়দি সেসব বই আনলেই পড়তে বসে যেতাম। সেসব দেখে মা বকতেন প্রায়ই।তিনি বলতেন, "নিজের পড়ার বই গুলো এভাবে মনযোগ দিয়ে পড়লে এতদিনে দেশ উদ্ধার করে ফেলতিস"।
তারপর মাধ্যমিক দিয়েই সিনিয়র সদস্যের কার্ড পেলাম। আর তার ফলে সমস্ত বই পড়ার অধিকার পেলাম। তবে তখন নতুন সমস্যা দেখা দিলো। ৫০০ টাকার থেকে বেশী দামী যে কোনোও বইয়ের জন্য টাকা জমা দিতে হবে। যেদিন বই ফেরত দেবে সেদিন টাকাটাও ফেরত পাওয়া যাবে। কিন্তু অত টাকা হাতে ছিল না, তাই বাড়ি এনে বই গুলো পড়া হত না। সেই দিদি বুদ্ধি দিলেন ওখানে বসে বই পড়লে টাকা জমা দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। এই কারণেই মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে, ছুটির অনেকটা সময় লাইব্রেরীতে বসে এইসব বই গুলো পড়েই কেটেছে।
সেসময় একবার আমাদের এলাকায়, 'স্বরচিত গল্প 'লেখার প্রতিযোগিতা হয়েছিল।।সেখানে আমি অংশগ্রহন করে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলাম। উপহার স্বরূপ বীভূতিভূষন বন্দোপাধ্যায় এর "পথের পাঁচালী" হাতে পেয়েছিলাম। কী ভীষণ আনন্দ হয়েছিল সেদিন, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। বাড়ির সকলকে বইটা হাতে নিয়ে বারবার দেখিয়েছিলাম। আমার প্রথম পাওয়া উপহার, সেই আনন্দের রেশ ছিল বহুদিন।
আমার বুবু , আমার ভাই সবসময় উৎসাহ দেন লেখার জন্য। তিনি নিজেও খুব ভালো লেখেন, কিন্তু ফেসবুকে পোস্ট করেন না। কতবার বলেছি, কিন্তু তিনি সেসব শুধুমাত্র নিজের ডাইরিতেই সীমাবদ্ধ রাখেন।
তারপর একদিন লাইব্রেরীর ওই দিদি বদলি হলেন। তাঁর জায়গাতে 'রবি দা' এলেন। তারপর অনিতা দি ।তিনিও কিছু দিন থেকে বদলি হলেন অন্য জায়গায়। নুতন এক দিদি এসেছেন এখন। তার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক থাকলেও তিনি একটার বেশী বই দিতে চান না কখনোই। জানি, দিদি হয়তো লিখাটা পড়ে একটু রাগ করবেন, কিন্তু সত্যিটা তো সত্যিই। আসলে তিনিও হয়তো নিয়মের বেড়াজালে বাঁধা, তাই একটা কার্ডে একটার বেশী বই দিতে অপারগ।
এখন ফেসবুকের যুগ। এখানে বহু মানুষ আছেন যারা নিজেদের ওয়ালে বিভিন্ন বিষয়ে খুব ভালো লিখেন। তাদের লেখা পড়ে সমৃদ্ধ হই প্রতিনিয়ত। রূমাশ্রী দি, অর্পিতা দি, অদিতি দি, জান্নাতুল সহেলী,পল্লবী দি, ও প্রতিতী দি,লিম, তাপস দা, শান্তনু দা, মহম্মদ আলি জীন্না দা, প্রভাত ঘোষ,সাহেবুল দা, সরিয়ত দা, কাজী আজিজুর রহমান কাকু, ভাস্কর দা, শুভায়ুর রহমান দা, অপু, শাহাজাদা থান্দার 'সেখ সাবির মোল্লা , সুমনা দি, মহম্মদ ঘোরী শাহ্ দা, ইমাম আলি দা ,পছন্দের তালিকা দীর্ঘ। সকলের নাম এখানে লিখতে গেলে দিন শেষ হয়ে যাবে। ইনাদের সকলে লেখা পড়ি, মন ছুঁয়ে যায়। কত কী শিখি, কত কী ভাবার উপাদান পাই। সেসব ভাবনাগুলো নিয়ে মাঝে মধ্যে আমিও টুকটাক লেখার চেষ্টা করি।
এখন আমাদের লাইব্রেরী কেমন যেন পাঠকশূন্য হয়েই থাকে সারাটাদিন। নুতন প্রজন্ম হয়ত সারাটাদিন হাতের স্মার্ট ফোনেই ব্যস্ত থাকে হাতের ফাঁকা সময় টুকুতে। তবুও আমার ওই লাইব্রেরীর নতুন বইয়ের গন্ধ এখনোও অনেক প্রিয়। বইয়ের পাতা খুলে অক্ষরের সাগরে ভাসতে ভাসতে আনমনা হয়ে হারিয়ে যাই অজানা অচেনা শব্দের দেশে।
তাই আমি চাই আমার সেই ছোটোবেলার স্মৃতিমাখা লাইব্রেরী আরোও আরোও অনেক বড় হয়ে উঠুক। পাঠকের সমাগমে সারাদিন ব্যস্ত থাক আমার লাইব্রেরী। সমস্থ আলমারী গুলো ভরে উঠুক রংবেরঙের বইয়ের মলাটে। আরোও অনেক অনেক বড় হোক আমাদের এই ছোট্ট দীননাথ স্মৃতি পাঠাগারটি এই কামনা করি।💓💓💓💓💓💓💓💓💓💓💓
Comments