আশ্রয়
রেশিমন খাতুন
বাস থেকে হানিফা যখন নামল তখন সূর্য মাথার উপরে। চৈত্রের রোদে ঝলসাচ্ছে চারিপাশটা এখনো বেশ কিছুটা পথ হাঁটতে হবে। দুটো ভ্যান, একটা মোটর ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। তাতে চাপার পয়সা কোথায়? কটা টাকাই বা আছে? কাপড়টা ভাল ভাবে টেনে হাঁটতে শুরু করে।
হাঁসগুলো এই দুপুর বেলা প্যাঁক প্যাঁক করে কানের বারোটা বাজিয়ে দিলো। তাদের কে কুঁড়ো ভাতটা খাইয়ে সদির দরজাটা লাগিয়ে বদনা থেকে পানি গড়িয়ে হাত ধুচ্ছিল হালিমা। তখনই দরজায় ধাক্কা। এই দুপুর বেলাতে কে এলো? একটু বিরক্ত মুখেই দরজাটা খুলল।
"তা তুমি?"
"কেমন আছো ভাবি?"
"ভালো"
মুখে বিরক্তির ভাবের খুব একটা পরিবর্তন হলো না তার দূর সম্পর্কের ননদ কে দেখে। হানিফা বারান্দার চৌকিটাতে গিয়ে বসে।
"কী গরম। ফজল কোথা?"
"বাড়ি আসেনি"
"তা বিয়ের কথা কিছু হলো?"
"ওসব কথা এখন থাক। যাও, হাত মুখ ধুয়ে ঠান্ডা হও"
"গা'টা একেবারে ধোবো। কী গরম আজ।"
লেবু টিপে সরবত বানিয়ে হানিফাকে দেয় হালিমা।
"কল নতুন বসালে ভাবি? ভালো করেছো। পানি আনার কষ্টটা গেল"
ঠান্ডা পানি গায়ে ঢালতে ঢালতে বহু কথা ভাবছিল হানিফা। কোথাও একটু শান্তিতে থাকার জায়গা নেই। ছেলে-বৌমার সঙ্গে চরম ঝগড়া হলে এখানে মাঝে মাঝে আসে। তাতে ভাবি খুশি হয়না সেট ভালোই জানে। তবুও বেশ কিছুদিন কাটায় টেনেটুনে। সব কাজকর্ম করে এখন এই বয়সে যে কোনোও কাজই কষ্ট লাগে। চুপ করে বসে খাওয়াবে কে? ভাবির মুখ হয়তো তাতে আরোও ব্যাজার হবে। ওখানেও ছেলের বৌ মুখ ঝামটা দেয়, কথা শোনায়। স্বামী মারা যাওয়ার পর নিজের ঘর আর নিজের থাকল না। মুখ বুজে পড়ে থাকলে হয়, কিন্তু রাগের বশে সেও কথা শোনায়। তখনই যে মাগি উঠে পড়ে লাগে। ঝাঁটা মারো, ঝাঁটা মারো মুখে।
হালিমা বেশ যত্ন করেই খাওয়ায় এবেলাটা। কচুর ডাল, কুচো মাছের টক, কুমড়োর ছেঁচকি।
"খেয়ে উঠে তুমি একটু গড়াও। আমি রাহিলাদের বাড়ি থেকে দুধটা নিয়ে আসি"
হানিফা খেয়ে উঠে এঁটো বাসন গুলো কলতলায় ধুয়ে মেজে রাখে। দুখান ঘর, বারান্দা, রান্নার চালা, কলতলা, গোসলখানা সব কিছু পরিপাটি। পেয়ারা গাছের পাতাগুলো জানালার শিকে এসে ঠেকেছে একটা কঞ্চি বেয়ে পুই লতা উঠছে। সেখানে কয়েকটা ফরিং উড়ছে। চৌকির য়পরে বিছানাটা গোটানো। একটা পাটি পাতা। তার উপরেই একটা বালিশ টেনে শরীরটা এলিয়ে দেয়। ঘরের কোনায় হাঁড়ির সারি। পাশে তাকের উপরে সারি সারি কৌটো। একপাশে আলনাতে কাপড় গোছানো, দেওয়ালে ক্যালেন্ডার ঝুলছে। আর এককোনে খেজুরের তালাই গুটিয়ে লম্বা করে রাখা। প্রায় একই রকম আছে ঘরটা।
এসব দেখতে দেখতেই চোখটা একটু লেগে এসেছিল। হালিমা দুধ নিয়ে ফিরল। কেরোসিন স্টোভটা ধরিয়ে দুধটা জ্বাল দেয়।
"একটু চা খাবে?"
"এখন চা? তা দাও।"
অনেকদিন খাঁটি গরুর দুধের চা সে খায়নি। তাদের ঘরেও দুধ আসে রোজ, কিন্তু সকালে শুধু লাল চা দেয় মুখপুড়ি বৌমা টা। একটু বেশী করে দুধ আর চা পাতা দিয়ে কড়া করে চা বানিয়ে দেয় হালিমা, সঙ্গে দুটো লেড়ুয়া দেয়। চা-টা খেয়ে ঘুম ভাব দূর হয়, মনটা বেশ হাল্কা লাগে। এটা সেটা গল্প করতে করতে বেলা গড়ায়।
আসরের আজান হয়। দুজনেই উঠে অযু করে নামাজ পাটি পেতে নামাজ আদায় করে। নামাজের শেষে দুই বৃদ্ধা হাত তুলে কোনোও এক অদৃশ্য শক্তির কাছে নিজেদের কষ্টের কথা জানায়। নামাজ শেষে একটা কাঁথা নিয়ে সেলাই করতে বসে হালিমা।
"তা ফজলের বিয়ের কথা কিছু ভাবলে? দেখা শোনা হয়নি কিছু?"
"আমি কী ওকে ধরে বসে আছি নাকি মানা করেছি বিয়ে করতে? আমি একা মেয়ে মানুষ, কোথায় মেয়ে দেখতে যাবো?"
"তোমাকে একটা ফোন নাম্বার দিছিলাম।ফোন তো করো নি মনে হয়। আমাদের ওখানে একটা ভালো মেয়ে ছিল"
এই সময় পাশের বাড়ির তুলির মা ঢুকল দরজা ঠেলে। কথা আপাতত আর এগোলো না। তাদের পাশের বাড়িতে যখন থেকে ল্যান্ড লাইন ফোনের কানেকশন এসেছে, সে পরিচিত সকলকে ফোন নাম্বার টা দেয়।
তার খুব ইচ্ছে "ও বিলালের মা, তোমার ফোন এয়েছে" বলে পাশের বাড়ি থেকে কেউ হাঁক দেবে। আর সে গিয়ে ফোন ধরে কথা বলবে। কিন্তু কেই বা আছে, তার খোঁজ নেওয়ার। তবুও সে নাম্বার টা একাধিকবার দেয় পরিচিত মানুষদের।
বেশ কয়েকটা দিন কাটার পর হালিমা বলে, "আর কতদিন ছেলে-বৌমার উপরে রাগ কিরে বাড়ি ছেড়ে থাকবে? ওটা তো তোমারই বাড়ি। সবার কথায় এত কান দেবে কেন?"
হানিফা কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে থামিয়ে নেয়। পরদিন সকালে সে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে যায়। যাবার সময় হালিমা সেরটাক আতপ চাল, দুটো নারকেল, একতাল ঢিমেগুড়, বাড়ির গাছের একটা পাকা পেঁপে, কিছু ছোলা একটা কাপড়ের পুঁটুলিতে বেঁধে দেয়। হাতে পঞ্চাশটা টাকাও ধরিয়ে দেয়, আর বলে, " ছেলে-বৌমার সাথে একটু মানিয়ে গুছিয়ে শান্তি করে থেকো"।
"হ্যাঁ ভাবি, চেষ্টা করব"। চোখের কোনটা ভিজে ওঠে। ইচ্ছে হয়, হাতে পায়ে ধরে বলে, "আর কটা দিন থাকতে দাও"। কিন্তু চোখ লজ্জায় সেটুকু আর বলে উঠতে পারে না। যেতে যেতে আর একবার বলে, "ভাবি, নাম্বার টা লাও। সময় মতো ফোন কোরো।"
সে যখন বাড়ি পৌঁছালো, সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। বাড়িটা শুনশান, সে নিজের ঘরে ঢোকে। ছেলের বৌ গোলাপি টিভি দেখছে মনে হয়। ছেলে কখন ফিরবে ঠিক নেই। কেউ জানবেও না তার বাড়ি ফেরার খবরটা। জেনেই বা কী লাভ? কেই বা তার জন্য ভাতের থালা সাজিয়ে অপেক্ষা করছে? এই একলা ঘরটা দেখে অদ্ভুত শূন্যতা ভর করে, বড্ড অসহায় মনে হয় নিজেকে। হু হু করে কান্না পায় তার। একটু রাত হলে ছেলে বাড়ি আসে, সাথে ভাত ও আসে। খাওয়া দাওয়া করে মেঝেতে চাটাই পেতে গুটিশুটি মেরে শোয় হানিফা। বড্ড মাথাটা ধরেছে, হেঁটে আসতে গিয়ে রোদের তাত লেগেছে মনে হয়। কপালে হাত লাগিয়ে দেখে,গা টা একটু গরম মনে হচ্ছে। মাঝ রাত্তিরে ঘুম ভাঙে, বড্ড পিয়াস লেগেছে। অন্ধকার ঘরে পানির ঘটিটা কোথায় রেখেছে হাতড়িয়ে খুঁজে পাচ্ছে না। উঠতে পারে না, শরীর অনেক ভারী লাগছে। অস্ফুট জড়ানো আওয়াজ দেয়, "অ বিলাল...বিলাল...বাবা বিলাল...
নিকষ কালো অন্ধকার ঘরেও চোখটা অন্ধকার হয়ে আসে।
খাঁ খাঁ দুপুর...মা চুলে লাল ফিতে দিয়ে বিনুনি করে দিচ্ছে...আব্বার সঙ্গে মেলা দেখতে যাচ্ছে...পায়ে ধুলো...জিলিপি...পাঁপড়...কী মজা..তার স্বামী একটা কাপড় এনেছে, "দেখ তো বৌ কেমন লাগছে?"...বিলাল ছোটো ছোটো পায়ে হাঁটছে...মা মা আমি পড়ে গেছি... দেখি বাবা কোথায় লেগেছে তোর... আয় ফুঁ দিয়ে দিই বাপ আমার।
ঘুম থেকে আজ উঠতে একটু দেরীই হয় বিলালের। রাতে ঘুম ভালো হয়নি, কেমন চাপধরা লাগছিল বুকটাতে। কাল খাটাখাটনি বেশিই হয়েছে একটু, হয়তো তাই। সে রাজ মিস্ত্রির কাজ করে পাশের গাঁয়ের ঠিকাদারের কাছে। বেশ বেলা হয়ে এলো, চটপড় উঠে কলপাড় থেকে মুখ ধুয়ে আসে।
"ও গোলাপী, চা দে।"
গোলাপী চা আর মুড়ি নিয়ে আসে।
"মা এখনোও ওঠেনি? অনেক সকালে ওঠে যে রোজ"
"আমি কী জানি? " মুখ বাঁকায় গোলাপী।
"যা না, গিয়ে দেখ না। বুড়ো মানুষ"
"যেছি" বলে মুখ ঝামটা দিয়ে চায়ের বাটিটা বিলালের হাতে ধরিয়ে চলে যায়। বিলাল চায়ের বাটি মুখে এক চুমুক চা নিতেই গোলাপীর চিৎকারে চা টা ছলকে জামাতে পড়ে বুকের কাছে জামাটা ভিজিয়ে দেয়। ধড়ফড় করে ছুটে গিয়ে যায় বিলাল। জিজ্ঞেস করে, "কী হলো?"
দেখে মায়ের শরীর চাটাই থেকে আদ্ধেক বাইরে পড়ে আছে। চোখ দুটো আধখোলা, ঠোঁটের কোনে জমে থাকা গ্যাঁজলায় মাছি বসছে। হাতটা পানির ঘটিটার কাছে, ঘটিটা পড়ে পানিতে মেঝেটা ভিজে গেছে। গোলাপী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পাশে বসে আছে। বিলাল মায়ের গায়ে হাত দিয়ে দেখে শরীর ঠান্ডা।
কিছুক্ষণ পর বাড়ির উঠোনে গ্রামের লোক ভেঙে পড়ে। খবর পেয়ে হালিমাও ছুটে আসে। লাশ বাইরে বের করে বারান্দায় রাখে। শেষ রাতের বিছানা,কাঁথা বাইরে বের করে। হালিমার চোখে পড়ে একপাশে পুঁটুলিটা একগাদা পিঁপড়ে গুরটাতে বসেছে। পেঁপেটা অর্ধেক পচে গেছে সেখান থেকে মাছি উড়ছে দু- একটা......
Comments